অধ্যাপক ডাক্তার চিত্তরঞ্জন শর্মা: পৃথিবীর বিখ্যাত ব্যক্তিদের মতে ধর্ম, কর্ম, সাহিত্য ও সংস্কৃতি ও শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রতিভাশালী যাঁরা পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন। হিতকর আবিষ্কারাদি যাঁহাদের জীবনব্যাপী কষ্টকর গবেষণা ও মতবাদের ফল হিসেবে প্রাপ্ত হওয়া যায়, তাঁদের প্রায় সকলেই অতীত জীবনের প্রারম্ভে অপমানিত, লাঞ্ছিত, উপেক্ষিত এমনকি উৎপীড়িত হয়েছেন। চিকিৎসা ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথি আবিষ্কারের জনক হ্যানিম্যানের জীবন সংগ্রাম অন্যতম উদাহরণ।
স্যামুয়েল ক্রিস্ট্রিয়ান ফ্রেডারিক হ্যানিম্যান বিগত ১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দের ১০ এপ্রিল ইউরোপের স্যাক্সনির মিছেল নগরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম প্রয়াত ক্রিস্টিয়ান গডফ্রায়েড ও মমতাময়ী মাতার নাম জোহানা ক্রিস্টিয়ান হ্যানিম্যান।
হ্যানিম্যানের পিতা চীনামাটির চিত্রকর্ম করে জীবিকা উপার্জন করতেন। পাঁচ বছর বয়স্ক হ্যানিম্যানকে তিনি প্রত্যহ নির্দিষ্ট সময় চিন্তা করতে পরামর্শ দিতেন। তিনি পুত্রকে উপদেশ দিতেন “সকল বিষয়ে পরীক্ষা করিয়া দেখিবে” যেটি সত্য তাহাই গ্রহণ করিবে। হ্যানিম্যান অতি অল্প বয়সে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ষোড়শ বছর বয়স কালে তিনি মিসেন বেসরকারি বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তাঁর পিতা বহুবার বিদ্যালয় ত্যাগ করে অন্য কাজে নিযুক্ত করতে চেষ্টা করেছিলেন। শিক্ষকদের অনুরোধে হ্যানিম্যান পড়ার সুযোগ পান। হ্যানিম্যান রাত জেগে পড়ালেখা চালাতেন। কিন্তু পিতা তেল খরচ বহন করতেও অপারগতা প্রকাশ করতেন। পিতার অজান্তে একটি মাটির প্রদীপ জ্বেলে রাত্রে লেখাপড়া করতেন। ২০ বছর বয়সে হ্যানিম্যান ল্যাটিন, গ্রীক, ইতিহাস, পদার্থবিজ্ঞান ও হিব্রæ ইত্যাদি বিষয় শিক্ষা লাভ করেন। ভিয়েনায় শিক্ষা গ্রহণের নিমিত্ত অর্থ সঞ্চয় করতেন। বারণ ডন্ ব্র্যাকেন বলের বেসরকারি চিকিৎসক থাকাকালে হ্যানিম্যান ২৪ বছর বয়সে গ্রীক, ল্যাটিন, ইংলিশ, হিব্রæ, ইটালিয়ান, সিরিয়াক, এরাবিক, স্প্যানিশ, জার্মান ও চ্যালডেইক ইত্যাদি ভাষায় বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন।
হ্যানিম্যান ১৭৭৯ খ্রিস্টাব্দে এনলার্জেন বিশ্ববিদ্যালয় হতে এলোপ্যাথি শাস্ত্রে এম.ডি. উপাধি প্রাপ্ত হন। ১৭৮২ সালে তিনি দেশাউ নগরের কুচলারের কন্যা জোহানা হেনরিয়েটা লিওপোন্ডাইন মুচলাকে বিয়ে করেন। তিনি গোমারন ধর্ম মন্দিরের চিকিৎসক নিযুক্ত হন। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, তখন তিনি পুরাতন ক্ষত চিকিৎসা নামক পুস্তক রচনা করেন। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি লিপজিক প্রত্যাবর্তন করে ডাক্তার উইলিয়াম কালেনের “এ ট্রিটিজ অন দ্য ম্যাটেরিয়া মেডিকা” অনুবাদ কালে চায়না সেবন করে সবিরাম জ্বরের লক্ষণ প্রাপ্ত হন। ১৭৯১ সালে দারিদ্রতার কারণে স্টাটারিজ নামক গ্রামে গমন করেন। ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে হুফিল্যান্ড সম্পাদিত “জার্নাল ফর দি প্রাক্টিসিং ফিজিশিয়ান্স নামক পত্রিকার ঔষধ সমূহের শক্তি নির্ণয়ের নতুন প্রভাব শীর্ষক এক গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রচনা করেন।
বেলেডোনা পরীক্ষা কালে দেখলেন যে, যেই ঔষধ রোগীকে সুস্থ করে, সেই ঔষধ অসুস্থ করার ও ক্ষমতা রাখে। উক্ত ঔষধ গোপনে ব্যবহার করায় আইন বিরোধী অপরাধে ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে কেলিকাস্টলাটারের স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হন। পথে শকট জলে পড়ে যাওয়ায় তিনি সর্বস্ব হারান। কন্যা আঘাতপ্রাপ্ত হয় ও পুত্র সন্তান নিহত হয়। তিনি নিজেও ভীষণ আঘাতপ্রাপ্ত হন। ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে তিনি হ্যামবার্গ হতে মোলেন নগরে গমন করেন। কিন্তু তাকে সেখানে বাস করতে দেয়া হয়নি। উল্লেখযোগ্য যে, তিনি সমস্ত দিন হ্যালাবের ভৈষজ্য বিজ্ঞান অনুবাদ করে যা পেতেন অতি কষ্টের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করতেন। সাবানের অভাবে আলু দিয়ে কাপড় ধৌত করতেন। খাদ্য ভাগ করে সকলে খেতেন। ম্যাচান হতে উইটেনবার্গে ও পরে টয়গো নামক স্থানে ছয় বছর ছিলেন। সেখানেও বিরুদ্ধোবাদীরা থাকতে দেননি। সর্বশেষ তিনি লিপোজিক গমন করেন। হোমিওপ্যাথি প্রচার প্রসারের জন্য মহাত্মা স্যামুয়েল ক্রিস্ট্রিয়ান ফ্রেডারিক হ্যানিম্যান অত্যাচারিত, প্রতীড়িত, নির্যাতিত, লাঞ্ছিত হলেন। অথচ ছাত্র, চিকিৎসক ও আপাময় জনসাধারণ বিশ্বব্যাপী উপকৃত হচ্ছেন।
হ্যানিম্যানের ঔষধ পরীক্ষার প্রথমাংশ ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে ল্যাটিন ভাষায় প্রকাশিত হয়। হোমিওপ্যাথির অতি প্রয়োজনীয় পুস্তক অর্গানের ১ম সংস্করণ মুদ্রিত হয়। ইহাতে হ্যানিম্যান হোমিওপ্যাথি নাম ব্যবহার করেন। অর্গাননে তিনি ১০০ পৃষ্ঠাব্যাপী মুখবন্ধে তখনকার চিকিৎসার সমালোচনা করেন। তিনি ব্যবহারিকভাবে হোমিওপ্যাথির আলোচনা করেন। তিনি বহুকাল ধরে তখনকার প্রচলিত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সমালোচনা করেন। ফলে তাঁকে হাতুড়িয়া, মূর্খ ও অজ্ঞ ইত্যাদি ভাষায় গালিগালাজ করতেন।
১৮১১খ্রিস্টাব্দে তার পুত্রের নাম ব্যবহার করে তিনি উহার প্রতিবাদ করেন। স্মরণযোগ্য যে, এই বৎসরই তিনি মেটেরিয়া মেডিকা প্রকাশ করে তাদের যথাযথ উত্তর দেন। প্রতুত্তর হিসেবে একটি প্রবন্ধ লেখেন “পূর্বপুরুষ গণের উদ্ভভ্রান্তি সম্বন্ধে নিবন্ধ” ফলে কেউই ইহার প্রতিবাদ করতে সাহসী হননি। তিনি প্রতি বুধবার ও শনিবার দুইটা হতে তিনটা পর্যন্ত চিকিৎসা সংক্রান্ত বক্তব্য দিতেন। লিপজিকের চিকিৎসা বিদ্যালয়, আইন বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রগণ শুনতেন। মিশ্রিত ঔষধ ব্যবহার সংক্রান্ত বিষয়ে বক্তব্য রাখতেন। ফলে ওষুধ বিক্রেতাগণ আদালতের শরণাপন্ন হন। সেইখানেও অত্যাচারিত হয়ে ১৮২১ সালে কোইথেনে গ্রান্ড ডিউক ফ্রেডারিকের আশ্রয় গ্রহণ করেন। স্বনামধন্য ডিউক হ্যানিম্যানকে ঔষধ প্রস্তুত ও ব্যবহার করার অনুমতি দেন। ইতিমধ্যে “ক্রনিক ডিজিজেস” লেখা হয়।
১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে জানুয়ারি মাসে হ্যানিম্যান লিপজিকে একটি হোমিওপ্যাথিক হাসপাতাল স্থাপন করেন। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে ২৮শে জানুয়ারি হ্যানিম্যান ম্যাডাম মিলানিকে বিবাহ করে প্যারী গমন করেন। এ সংসারে কোন সন্তান জন্মগ্রহণ করেনি। পরবর্তীতে প্রায় ০৮ বছর বসবাস কালে তিনি ৪০,০০,০০০ ফ্রান্স চিকিৎসাসূত্রে অর্জন করেন। হোমিওপ্যাথির জনক মহাত্মা স্যামুয়েল ক্রিস্টিয়ান ফ্রেডারিক হ্যানিম্যান মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে অতি মৃদুস্বরে তিনি বলেছিলেন “আমি বৃথা জীবন ধারণ করি নাই”।
হোমিওপ্যাথিক কি?
দুইটি গ্রীক শব্দের সংযোগে হোমিওপ্যাথি নামের উৎপত্তি। মহাত্মা হ্যানিম্যানের মতে কাহার ও সুস্থ দেহে কোন একটি ঔষধ পূন: পূন: প্রয়োগ করলে ভেষজ লক্ষণজাত কতকগুলি পীড়া বা রোগ সদৃশ্য লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকে। কোন পীড়ায় সে সমস্ত লক্ষণ প্রকাশিত হলে সেই পীড়ায় সেই ঔষধের সূক্ষ¥মাত্রার দ্বারা রোগীর চিকিৎসা করলেই প্রকৃত হোমিওপ্যাথি বা সদৃশ বিধান চিকিৎসা বলা হয়। হোমিওপ্যাথি মূলত: ঝরসষষরধ ঝরসষষরনঁং, ঈঁৎবহঃঁৎ.
ডব ঃৎবধঃ ঃযব ঢ়ধঃরবহঃ, হড়ঃ ঃযব ফরংবধংব-ড়িড়ফ.
উদ্দেশ্য:
মহাত্মা হ্যানিম্যানের মতে চিকিৎসকের মহৎ এবং একমাত্র উদ্দেশ্য রোগীকে নীরোগ করা ও রোগীকে পুনরায় পূর্বের স্বাস্থ্যের আনয়ন করা।
আদর্শ:
১। অচিরে, ২। নিরুপদ্রবে, ৩। স্থায়ীভাবে, ৪। স্বাস্থ্যের পূর্ন প্রবর্ত্তন অথবা সর্বাপেক্ষা সরল বিশ্বাসযোগ্য ও অনিষ্টবিহীন সম্পূর্ণভাবে এবং ৫। মুখবোধ্য বিধানমতে রোগের দূরীকরণ বা ধ্বংসসাধন আরোগ্যের সর্বোচ্চ আদর্শ।
মহাত্মা স্যামুয়েল হ্যানিম্যান তার ক্রনিক ডিজিজ নামক গ্রন্থে সোরা (চর্মরোগ), সাইকোসিস (প্রমেহ), সিফিলিস (উপদংশ), গনোরিয়া (পূজ ধাতুরোগ) সম্পর্কে বিশদভাবে আলোচনা করেছেন। উপরোক্ত লক্ষণ সমূহের বিবরণ দেয়া সময় সাপেক্ষ।
হোমিওপ্যাথির মতে দ্বিবিধ: তরুণ ও পুরাতন।
তরুণ রোগ: তরুণ রোগ ও অচির রোগ বলতে বুঝায় যা হঠাৎ আক্রমণ করে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে পেতে তলপক্ষনের মধ্যে বা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রোগীকে শেষ করে ফেলে বা নিজে শেষ হয়ে যায়। যেমন জ্বর, সর্দি, কাশি ইত্যাদি।
চির রূপ বা প্রাচীন পীড়া: পুরাতন বা চির রোগ বলতে বুঝায় যা সোরা (চর্মরোগ), সাইকোসিস (প্রমেহ), সিফিলিস (উপদংশ) হতে উৎপন্ন হয়ে সারা জীবনে কষ্ট দিতে থাকে।
রোগীর অতীত ও বর্তমান অবস্থা জানতে হয়। জীবন বৃত্তান্ত জেনে রোগ শক্তি ও ঔষধ শক্তি পর্যালোচনা করে একসময় একটি মাত্র ঔষধ প্রয়োগ করা হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার নিয়ম। একটি অন্য আরেকটি ঔষধ মিশ্রণ করা হোমিওপ্যাথি নীতি বিরুদ্ধে।
স্বনামধন্য হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকগণ রোগীর পিতা, মাতা, ভাই, বোন, দাদার স্বাস্থ্য, রোগীর অসুস্থতার সকল কারণ, কোন ঋতুতে রোগ বৃদ্ধি পায় ও কমে ইত্যাদি জানতে চেষ্টা করেন। তাছাড়া আহার, বিহার, রুচি, অরুচি, দেহের গঠন, মনের চিন্তা, স্বভাব চরিত্র, স্বপ্ন বৃত্তান্ত, মহিলাদের ঋতুকালীন উপসর্গ এবং গর্ভাবস্থার বিবরণ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে জেনে চিকিৎসা সেবা দেন। যত রকমের পদ্ধতি অনুস্মরণ করা হয় না কেন সঠিক ঔষধ নির্বাচন করা হচ্ছে চিকিৎসকদের মূল কাজ।
মহাত্মা হ্যানিম্যান অভিজ্ঞ এলোপ্যাথিক চিকিৎসক ছিলেন। আরোগ্যের প্রাকৃতিক নিয়ম “সমমত” তিনিই আবিষ্কার করেছেন। হোমিও ঔষধ ব্যবহারিক ফল প্রচার করেছেন। অর্গানন লেখার উপর অজস্র, অবিশ্রান্ত, গালিবর্ষণ আনয়ন তা বলাই বাহুল্য। তিনি বহুবার প্রচলিত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন। বিরুদ্ধবাদীগণ মূর্খ, অজ্ঞ, হাতুড়িয়া, প্রভৃতি ভাষায় গালাগাল দিতেন। তিনি অনাহার, অনিদ্রা ও শোক দুঃখ ভোগ করেছেন। তাঁর পুত্র সন্তান হারিয়েছেন। কন্যা আহত হয়েছে। শকট জলে ডুবে যাওয়ায় জীবনের শেষ সম্বল পর্যন্ত হারান। তবুও তিনি হোমিওপ্যাথি গবেষণা ত্যাগ করেননি। বিরুদ্ধোবাদীদের হামলায় হোমিওপ্যাথির আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সংশ্লিষ্ট ছাত্র, শিক্ষক, ও হোমিও ব্যবসায়ীরা আজ সমাজে প্রতিষ্ঠিত যতদূর জানা যায়। অনুমোদিত হোমিও কলেজ সমূহের শিক্ষকদের অনুদান দেয়া শুরু করেছেন। স্বরেজমিনে জরীপ করলে প্রকৃত অবস্থা জানা যাবে। অন্যান্য কলেজের মত জমি, দালান, শিক্ষক, অর্থ, যানবাহন, ছাত্রাবাস, পাঠাগারসহ সকল সুযোগ সুবিধা পেলে হোমিওপ্যাথি সেবা বিশ্বে শীর্ষস্থান অধিকার করবে। আমরা মহাত্মা হ্যানিম্যানের আত্মার সদগতি কামনা করছি। জয় স্যামুয়েল ক্রিষ্টিয়ান ফ্রেডারিক হ্যানিম্যান\
লেখক, চিকিৎসক ও প্রাবন্ধিক