কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ক্যাম্পগুলোতে দিন দিন অস্থিরতা বেড়েই চলেছে। বিশেষত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কিংবা মিয়ানমারবিরোধী কোনো ইস্যুতে আন্তর্জাতিক মহলে আলোচনা কিংবা কোনো প্রতিনিধিদল পরিদর্শনে এলেই ক্যাম্পে খুনোখুনি ও অরাজকতা বেড়ে যায়।
সাধারণ রোহিঙ্গাদের দাবি, মিয়ানমারই এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী। আরসাকে দিয়ে এসব ঘটাচ্ছে তারা।
আর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) বলছে, ক্যাম্পে সক্রিয় থাকা মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র কয়েকটি গোষ্ঠী এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।
বৃহস্পতিবার (৬ জুলাই) কক্সবাজারের উখিয়া ক্যাম্প পরিদর্শনে যায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রধান কৌঁসুলি করিম আসাদ আহমাদ খানের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের প্রতিনিধিদল। দলটি কুতুপালং ১ নম্বর পশ্চিম ক্যাম্পের এ/১ ব্লক পরিদর্শনকালে একই ক্যাম্পের এ/৯ ব্লকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় এবাদুল্লাহ নামে এক রোহিঙ্গাকে। যিনি ওই ব্লকের উপ-প্রধানের (সাব মাঝি) দায়িত্ব পালন করতেন।
পর দিন শুক্রবার (৭ জুলাই) ভোরে কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালীর ক্যাম্প-৮ ইস্টের পাহাড়ি এলাকায় আরএসও এবং আরসার সন্ত্রাসীদের মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলি হয়। ঘটনাস্থলে এপিবিএন পৌঁছলে পালিয়ে যায় দু-গ্রুপের সদস্যরা। গোলাগুলিতে মারা যান পাঁচজন।
এপিবিএন জানায়, নিহত পাঁচজনই আরসার সদস্য। একই ক্যাম্প থেকে বিকেলে আরও এক রোহিঙ্গার গলাকাটা মরদেহ উদ্ধার করে এপিবিএন।
রোহিঙ্গাদের দাবি, ক্যাম্পে কয়েকটি গ্রুপ রয়েছে। তারা এসব হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে। এ জন্য তারা সবসময় ভয়ে থাকেন। প্রশাসনকে জানালে গলা কেটে ফেলার হুমকি দেয়া হয়। ক্যাম্পে অস্থিরতা তৈরি করেছে আরসা ও আল ইয়াকিন। শুক্রবারও তারা গোলাগুলি করে পাঁচজনকে মেরে ফেলেছে। মিয়ানমারই এসব গ্রুপকে দিয়ে ক্যাম্পে এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে। ক্যাম্পে শান্তি নিশ্চিতের পাশাপাশি তারা দ্রুত নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরতে যেতে চান।
এদিকে ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তিত স্থানীয় বাসিন্দারাও। ক্যাম্পের অপরাধ দমনে যৌথ অভিযান চালিয়ে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি স্থানীয় জনপ্রতিনিধির।
উখিয়ার কুতুপালংয়ের রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘রোহিঙ্গা সশস্ত্র গ্রুপগুলো যেভাবে ক্যাম্পে অস্থিরতা তৈরি করছে তাতে স্থানীয়রাও আতঙ্কে রয়েছেন। আমরা চাই, ক্যাম্পে খুনোখুনিসহ সব ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বন্ধ হোক। প্রয়োজনে সব বাহিনীর সমন্বয়ে অভিযান চালিয়ে ক্যাম্প থেকে অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোকে আইনের আওতায় আনা হোক।’
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, প্রাথমিক দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, এসব ঘটনা পরিকল্পিত এবং টার্গেট কিলিং। আন্তর্জাতিক আদালতের লোকজন ক্যাম্পে আসার পরই যে ঘটনাটি ঘটেছে, এটা তাদের জন্য ততটা প্রভাব ফেলবে না। তবে রোহিঙ্গা যে উচ্ছৃঙ্খল, তা প্রমাণের চেষ্টা করা হয়েছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে যে বিভাজন তৈরি হচ্ছে তা তাদেরই ক্ষতি। এটা নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও সজাগ হতে হবে।’ এ ক্ষেত্রে সব বাহিনীর সমন্বয়ে যৌথ পরিকল্পনা ও অভিযান, অস্ত্রের উৎস বের করা জরুরি বলে জানান তিনি।
উখিয়ার ৮ এপিবিএনের সহকারী পুলিশ সুপার মো. ফারুক আহমেদ বলেন, ক্যাম্পে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী সংগঠন আরসা, আরএসও, নবী হোসেন গ্রুপ, মুন্না গ্রুপসহ কয়েকটি গ্রুপ রয়েছে। এরাই মূলত ক্যাম্পগুলোতে সক্রিয়। ক্যাম্পগুলো নিয়ন্ত্রণে নিতে এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের ওপর হামলা চালায়। এতে অনেক সময় তারা নৃশংসভাবে অনেককে হত্যা পর্যন্ত করে। তারা মাদক কারবার, হাটবাজারে চাঁদাবাজি ও অপহরণ করে অবৈধ অর্থ অর্জনের জন্য প্রভাব বিস্তার করছে। তবে এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ‘সন্ত্রাসীগুলোর তালিকা করা হয়েছে। গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়ে তাদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে। তবে এপিবিএনের কার্যক্রমে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কারণ, অনেক ক্যাম্প পাহাড়ে ও টিলার ওপর। এসব এলাকায় গাড়ি নিয়ে যাওয়া যায় না। হেঁটে সেখানে পৌঁছানোর আগেই পালিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। তারপরও আমরা বিভিন্ন কৌশলে তাদের গ্রেফতারে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি।’
কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্য বলছে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০২৩ সালের ৭ জুলাই পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১৮২টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে চলতি বছরেই ৪৯ জন, যাদের মধ্যে ৩২ জনই রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ব্যবস্থাপনায় জড়িত নেতা ও স্বেচ্ছাসেবক। তারা নানাভাবে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে আগ্রহী হতে কাজ করছিলেন।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাহামুদুল হক চৌধুরী বলেন, ক্যাম্পে ঘটা অপরাধ কর্মকাণ্ডে মিয়ানমারের পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে। মিয়ানমার থেকে ইয়াবা, আইস আনাসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত এসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। প্রত্যাবাসন ঠেকানোই তাদের মূল উদ্দেশ্যে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে অবশ্যই চিন্তিত। ক্যাম্পে ৩ ব্যাটালিয়ন এপিবিএন রয়েছে। সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা রয়েছেন। তারা প্রতিনিয়ত কাজ করছেন। আমরা তাদের সঙ্গে সমন্বয় করছি। এ ছাড়াও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে। তারপরও কিছু ঘটনা ঘটছে। আমরা সবাই চেষ্টা করছি, কীভাবে ক্যাম্পে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।’