গেল এক দশকে বিএনপির কোনো রাজনৈতিক পদক্ষেপই সফল হয়নি। তৃণমূল পর্যায়ে নিজেদের নেতাকর্মীদের কাছেও আস্থা হারিয়েছেন দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা। যে কারণে কেউই তাদের কথা শুনছেন না। তাদের পাহাড়সম এ ব্যর্থতাকে আড়াল করতে এবং রাজনৈতিক মনোবৈকল্য থেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পুত্র জয়সহ তার স্বজনদের বিরুদ্ধে গুজব ছড়াচ্ছে বিএনপি। সময় সংবাদের সঙ্গে আলাপে এমন মন্তব্যই করেছেন বিশ্লেষকরা।
এদিকে, এক ফেসবুক পোস্টে আওয়ামী লীগ জানিয়েছে, ‘উদ্ভট বিএনপি গুজব সেলের উদ্ভট গুজব!’ আওয়ামী লীগের ওয়েব টিমের সমন্বয়ক তন্ময় আহমেদ বলেন, সামাজিকমাধ্যম ব্যবহার করে বিএনপি যেসব গুজব ছড়াচ্ছে, তার কোনো সত্যতা নেই।
যেভাবে গুজব ছড়াচ্ছে বিএনপি
আওয়ামী লীগ জানিয়েছে, ‘সেই ২০১২ সাল থেকেই সজীব ওয়াজেদ জয়কে গ্রেফতার করে রাখে যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ, এটিই বিএনপির মিডিয়া সেলের ভাষ্য। সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকেও কানাডাতে গ্রেফতার করা হয়েছে, ২০১৮ সাল থেকেই চলছে এই গুজব। আবার ভিডিও’র ভেতরে তারা বলছে যে, বিএনপি ছাড়া এই বাংলাদেশের কোনো গতি নেই। সুতরাং, গুজব কারা করছে, এ কথা পানির মতো পরিষ্কার।’
সম্প্রতি লন্ডন থেকে ওয়েবসাইটে প্রকাশিত দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি অলিউল্লাহ নোমান এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘আমেরিকান গোয়েন্দাদের অনুসন্ধানে এক বাংলাদেশি কম্পিউটার বিজ্ঞানীর মাত্র ১০ বিলিয়ন মানি লন্ডারিং খুঁজে পেয়েছে!’
তন্ময় আহমেদ বলেন,
গত মে মাসে দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত সংবাদকে ঘুরিয়ে-প্যাঁচিয়ে সজীব ওয়াজেদ জয়ের নামে গুজব ছড়াচ্ছে একটি বেসরকারি টেলিভিশন ও বিএনপির গুজব সেলের সদস্য এম মাসুম রহমান। বিদেশের ব্যাংকে আটকে থাকা টাকাকে সজীব ওয়াজেদের পাচার করা টাকা বলে প্রচার করছে তারা।
তিনি আরও বলেন, দুর্নীতি ও অবৈধ টাকা পাচারের দায়ে দণ্ডিত বিএনপির পলাতক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উসকানিতেই এ গুজব ছড়ানো হচ্ছে। যুগান্তরে প্রকাশিত সংবাদে স্পষ্ট বলা আছে, এ টাকা রফতানিকারকদের টাকা, যা বিভিন্ন ব্যাংকে নানা জটিলতার কারণে আটকে আছে। সংবাদটির কোথাও সজীব ওয়াজেদ জয়ের নাম উল্লেখ নেই।
কিন্তু ওই বেসরকারি টেলিভিশনটি মনের মাধুরী মিশিয়ে একটি উদ্ভট গুজব বের করে দিল। এরপর ১৫ জুন জয়ের যুক্তরাষ্ট্রে ১০ বিলিয়ন ডলারের মানি লন্ডারিংয়ের সন্ধান পেয়েছে মার্কিন ট্রেজারি বিভাগের অফিস অব টেরোরিজম অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়ার ইন্টেলিজেন্স (টিএফআই), এমন একটা গুজব ছড়িয়েছে এম রহমান মাসুম তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে।
তন্ময় বলেন, কিন্তু টিএফআইয়ের অফিশিয়াল সাইটে ১৪, ১৫ জুনের খবর ঘেঁটে এরকম কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এমনকি সজীব ওয়াজেদ লিখে অনুসন্ধান করেও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। মাসুম কৌশলে সূত্র হিসেবে আমার দেশের সাংবাদিক অলিউল্লাহ নোমানের নাম উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সেই পোস্টের কমেন্টেই অলিউল্লাহ নোমান বলেন যে, তিনি নাম বলেননি। এটাই বিএনপির গুজব সেলের কৌশল!
এ প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ বলেন, প্রথমে গুজব সেলের কোনো এক সদস্য বিভ্রান্তিমূলক কোনো কথা ছড়াবে, এরপর সেই কথাকে সোর্স হিসেবে ব্যবহার করে গুজব সেলের সদস্যরা কাউকে জড়িয়ে সেটা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে। যেমন – তারেক রহমানের সরাসরি পেমেন্টে পরিচালিত একটি বেসরকারি টেলিভিশনের ইউটিউব চ্যানেলে এরকম একটি পোস্ট করা হয়। এরা আগেও গুগল থেকে কিছু ছবি নিয়ে সেখানে মালিকের নাম এডিট করে সজীব ওয়াজেদের নাম বসিয়ে দিয়েছিল।
তিনি জানান, এসব পেইড গুজববাজরা পলাতক তারেকের নির্দেশে এভাবে গুজব ছড়িয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়। লন্ডনে পালিয়ে থাকা তারেক রহমান কোনো আয় না থাকা সত্ত্বেও ৫টি বিলাসবহুল বাড়ি ও অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন, আর সেই সম্পদ দিয়ে দেশের বিরুদ্ধে আজগুবি খবর রটাচ্ছেন। যার কারণে মানুষ তাদের ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে বারবার।
‘রাজনৈতিক মনোবৈকল্য’ থেকে গুজব ফ্যাক্টরি
গেল এক দশকে সামাজিক ও রাজনৈতিক সব কর্মসূচিতেই সফল হয়েছে সরকার। বিপরীতে পথসভা থেকে শুরু করে জেলা জেলায় সমাবেশ করেও কোনো সাড়া পায়নি বিএনপি। অতীতে দলটির ধ্বংসাত্মক কর্মসূচির কারণে তাদের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সাধারণ মানুষ। যে কারণে কোনো উপায় না পেয়ে তারা এখন গুববের আশ্রয় নিয়েছে।
সময় সংবাদের সঙ্গে আলাপকালে এমন কথাই জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার প্রশান্ত ভূষণ বড়ুয়া। তিনি বলেন, ২০০৬ সালে ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে সৌদি আরব সফরে খালেদা জিয়া ৭৩টি সুটকেস নিয়ে যান। এটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। অথচ গত এক দশকে বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে সরকার দারিদ্র্যের হার অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে, সামাজিক নিরাপত্তা নজিরবিহীনভাবে প্রসারিত করেছে, ৫৩ লাখ মানুষকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ও দুই কোটির বেশি মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির সুবিধার মধ্যে নিয়ে এসেছে।
সবকিছু মিলিয়ে, বড় বড় প্রকল্পের কথা বলছি না, ছোট ছোট কাজ দিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কারণে আওয়ামী লীগের প্রতি, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা তৈরি হয়েছে। তাইতো সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শক্ত মাটিতে দাঁড়িয়ে আছেন, সেটিকে কোনোভাবেই চ্যালেঞ্জ করতে না পেরে বিএনপি এখন গুজব ফ্যাক্টরি করেছে।
গুজবকেই বিএনপি অস্ত্র বানিয়েছে মন্তব্য করে এ আইনজীবী বলেন, তারা আওয়ামী লীগ, গণতন্ত্র ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গুজবকে লেথাল ওয়েপন হিসেবে ব্যবহার করছে। বলা হয়ে থাকে, ভুয়া খবর মহামারির চেয়েও বেশি ছড়ায়। তারা এ সুযোগটি নিচ্ছে। গুজব দ্রুত ছড়ায়, এতে মানুষের মধ্যে একটা মানসিক দুশ্চিন্তা তৈরি হয়। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তারা এমনটা করছে।
ভবিষ্যতে তারা আরও বেশি করে গুজব ছড়াবে বলে আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন প্রশান্ত ভূষণ। কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, তারা রাজনৈতিকভাবে পুরোপুরি পরাজিত হয়েছে। একেবারে সহজ হিসাব, একটি উদহারণ দেয়া যেতে পারে। তারা যে সিটি নির্বাচন বর্জনের কথা বলেছেন, তাদের তৃণমূলের নেতারাও সেই আহ্বান গ্রাহ্য করেনি। অর্থাৎ বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে তাদের তৃণমূলের প্রত্যাশার কোনো মিল নেই।
তিনি আরও বলেন,
‘যে কারণে দেখা যায়, তাদের আজীবন বহিষ্কার চিঠিতে লেখা হয়েছে—‘আপনি একজন মোনাফেক, বেঈমান, মীরজাফর।’ বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে চিঠি দিয়ে তাদের তৃণমূল থানা ও জেলা পর্যায়ের নেতাদের এসব শব্দে সম্বোধন করা হয়েছে। একটি দল কতখানি মনোবৈকল্যে ভুগলে এটা বলতে পারে। আমি বলবো, তারা পুরোপুরি রাজনৈতিক মনোবৈকল্যের শিকার হয়েছে। এজন্যই তারা এসব করছে, গুজব রটাচ্ছে। তারা আরও গুজব রটাবে।’
তিনি বলেন, এর আগে পদ্মা সেতু নির্মাণকে কেন্দ্র করেও তারা গুজব ছড়িয়েছিল। তখন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বদনাম রটাতে বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে টার্গেট করেছিল। পরে বিশ্বব্যাংককে ভর্ৎসনা করে কানাডার আদালত বলেছিল, গাল-গল্পের ভিত্তিতে ভবিষ্যতে যাতে বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান কোনো পদক্ষেপ না নেয়।
গুজব ছড়ানোর বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়া যায় – জানতে চাইলে এ আইনজীবী বলেন, ‘এখানে আমাদের কিছুটা ঘাটতি আছে। যেমন- তারা যেসব দেশে আছে, সেসব দেশের আইনেই তাদের ধরা সম্ভব। কিন্তু আমাদের দিক থেকে ঠিক সে ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না বা নেয়া হয়নি। যে কারণে তারা নিয়ন্ত্রণহীণভাবে দায়মুক্তির সঙ্গে এসব করে যাচ্ছে। বলা হয়, গুজব অস্ত্রের চেয়েও ক্ষতিকর, তারা ঠিক সে কাজটিই করেছে।’
রাজনৈতিকভাবে সুবিধা করতে না পারার কারণে তারা এসব করছে বলে তিনি দাবি করেন। তিনি বলেন:
‘তারা বিভাগীয় সমাবেশ করল, পদযাত্রা করল, তারপর কী করবে? তাদের তো মানুষ বিশ্বাস করছে না। তাদের অতীতের বিশ্বাসযোগ্যতা খুবই খারাপ। এর আগে ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে তারা নারকীয় বর্বর বোমা হামলা চালিয়েছে। পেট্রোল ও আগুন সন্ত্রাস চালিয়েছে। ২০০১ সালে ক্ষমতায় গিয়ে তারা কী না করেছে!’
এ আইনজীবী আরও বলেন, বাংলাদেশকে তারা শ্মশান, মৃত্যু উপত্যকা বানিয়েছিল। যে কারণে মানুষ তাদের ওপর আর বিশ্বাস রাখতে পারছে না। তারা মারাত্মকভাবে বিশ্বাসযোগ্যতার সংকটে রয়েছে। এখন –
তৃণমূল পর্যায়ের নেতারাই বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের বিশ্বাস করে না।
গুজবের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব
গুজব রটনাকারীরা যেসব দেশে থাকেন, সেসব দেশের আইনেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব বলে মনে করেন প্রশান্ত ভূষণ। তিনি বলেন, অপপ্রচারের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করতে হবে। রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রচারে নামতে হবে আওয়ামী লীগকে। এছাড়া দেশের বাইরে সরকারের যে উইংগুলো অর্থাৎ দূতাবাসগুলো আছে, তাদেরকে এবং ওসব দেশে আমাদের তৃতীয় প্রজন্মের যে ছেলেমেয়েরা আছেন, তাদের সঙ্গে হাইকমিশনের নিবিড় যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
তিনি বলেন,
কারণ ওসব দেশের আইন কিন্তু খুবই কড়া। কাজেই যারা গুজব ছড়ায়, তাদের বিরুদ্ধে সেখানকার আদালতে মামলা করতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দিতে হবে যে, তারা আপনাদের উদারতা ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এভাবে গুজব ছড়াচ্ছে।
যারা গুজব ছাড়ায়, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার সব ধরনের সুযোগ আছে বলে মনে করেন তিনি। বলেন,
কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ আছে। গুজব রটনাকারীরা বেশিরভাগই রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছে। এ আশ্রয় দেয়ার মধ্যেই বলা আছে, তারা নিজ নিজ দেশের বিরুদ্ধে বা অন্য কোনো দেশের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক, সামাজিক কিংবা সন্ত্রাসী কোনো তৎপরতায় লিপ্ত হতে পারবে না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীরা এক ধরনের তথ্য সন্ত্রাসের ভূমিকায় লিপ্ত হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘সমাজের সর্বস্তরে বিশ্বাসযোগ্য প্রচার চালাতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র বলতো, ‘হি ইজ সান অব বিচ’। তখন হেনরি কিসিঞ্জার বলতেন, ‘হি ইজ সান অব বিচ; বাট হি ইজ আওয়ার সান অব বিচ’। এখন আমেরিকা প্রতিটি দেশে নিজেদের ‘সান অব বিচ’ খুঁজে বেড়াচ্ছে। আর বিএনপি স্বেচ্ছায় তাদের ‘সান অব বিচ’ হতে চাচ্ছে।’