নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার কুল্লাগড়া ইউনিয়ন। মেঘালয় পাহাড়ের ঠিক নিচে অবস্থিত এ এলাকাকে অনেকে চেনে বিরিশিরি নামে। আবার সাদা মাটির পাহাড় হিসেবেও এটি বেশ পরিচিতি। এর অপরূপ সৌন্দর্য মুগ্ধ করে সবাইকে। পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে একে গড়ে তোলা হলে এলাকার অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি বাড়বে মানুষের কর্মসংস্থান।
পাহাড়ি এ সীমান্ত উপজেলা দুর্গাপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, দীর্ঘদিন মাটি কাটায় পাহাড়ের মাঝখানে সৃষ্টি হয়েছে খালের ন্যায় ক্ষত। এরই মধ্যে সরকার এ মাটি কাটা বন্ধ করে দেয়ায় এখন সে ক্ষত হয়ে ওঠেছে যেন নয়নাভিরাম এক লেক। দূরে যতদূর চোখ যায়, ভেসে বেড়ায় মেঘ আর মেঘ। সাদা মাটির এ দেশে দেখা মেলে চিনামাটির পাহাড়, সোমেশ্বরী নদী, নীলচে-সবুজ পানির হৃদ, গির্জা, পাহাড়ি নৃ-গোষ্ঠি ছাড়াও দর্শনীয় বিভিন্ন স্থান।
সৌন্দর্যে ভরপুর বিজয়পুরের সাদামাটি
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর বিজয়পুরের সাদামাটি পেয়েছে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি। কিন্তু পর্যটন শিল্প বিকাশে এখানে তেমন কোনো উদ্যোগ না থাকলেও থেমে নেই পর্যটকদের আনাগোনা।
এর মূল আকর্ষণ হচ্ছে এখানকার হ্রদের পানি। চীনামাটির পাহাড়, যার বুক চিরে জেগে ওঠেছে নীলচে-সবুজ এ পানির হ্রদ। সাদা মাটির মাঝে এর রঙটাকে যেন আরও বেশি গাঢ় করে দিয়েছে। ঘুরতে আসা পর্যটকদের দাবি, গাছপালায় সবুজায়নসহ অবকাঠামোগত এবং যাতায়াতে সুবিধাসহ স্থানটিকে ঢেলে সাজালে পর্যটন বিকাশে বিশাল গুরুত্ব রাখবে নেত্রকোনায় দুর্গাপুরের এ সাদামাটি।
স্থানীয়দের মতে, সম্ভাবনাময় সাদা মাটির এ পাহাড়কে কেন্দ্র করে পর্যটন শিল্পের জন্য অবকাঠামোসহ পর্যটকদের যাতায়াত ও থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা করলে এ অঞ্চলের মানুষের কর্মসংস্থান বাড়বে। এছাড়া এলাকায় অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি বাড়বে সরকারের রাজস্ব আয়ও।
সুসং বিদ্যানিকেতনের সাবেক প্রধান শিক্ষক ও সেভ দ্য অ্যানিমেলস অফ সুসং-এর উপেদষ্টা এ কে এম ইয়াহিয়া জানান, জেলার দুর্গাপুর একটি সম্ভাবনাময় উপজেলা। এখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিদ্যমান। সমন্বিত পরিকল্পনা নিয়ে এটিকে শুধুমাত্র ধরে রাখার উদ্যোগ নিলেই হবে। এর জন্য আলাদা কিছু করতে হবে না।
এখানে পর্যটনের মতো এতো সুন্দর সুন্দর উপাদান আছে, যা রাঙ্গামাটি কিংবা সিলেটের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। যাতায়াত সুবিধাই কেবল ওইসব এলাকার চিত্র পাল্টে দিয়েছে। পাশাপাশি আছে থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা; যা নেত্রকোনায় হচ্ছে না। এটি নিশ্চিত হলে এ এলাকাও পর্যটনে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে সন্দেহ নেই। তাছাড়া বালু উত্তোলনের বাইরেও এতে এ অঞ্চলের মানুষের বৈধ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে।
পাহাড় কেটে মাটি উত্তোলন
নেত্রকোনার পাহাড়ি সীমান্তে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে পাহাড় কেটে মাটি উত্তোলন চলছিল। গত প্রায় ৬ বছর ধরে সরকার এটি বন্ধ করায় ভারসাম্য ফিরেছে এখানকার পরিবেশের। যদিও প্রায় সাত কিলোমিটার অংশ জুড়ে বছরের পর পর এ পাহাড়ে চলেছে নানান অরাজকতা। সাদা, গোলাপিসহ ভিন্ন রঙের এ মাটি কেটে দেশের সিরামিক কোম্পানিগুলোতে বিক্রি করায় একদিকে যেমন পরিবেশের বিপর্যয় ঘটেছিলো মারাত্মক, তেমনি প্রাণহানিও হয়েছে অনেক।
এ অবস্থায় পরিবেশবাদীদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফলে সরকার গত ২০১৭ সাল থেকে বন্ধ করে দিয়েছে পাহাড় কাটা এবং মাটি উত্তোলন। এরপর ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে নিবন্ধন পেতে আবেদন করে স্থানীয় প্রশাসন। পরবর্তীতে (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন ২০১৩ অনুযায়ী ২০২১ সালের ১৭ জুন জিআই পণ্য সনদ পায় নেত্রকোনার দুর্গাপুরের এ সাদা মাটি। কিন্তু সুরক্ষাসহ পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি আজও।
সাদা মাটির সন্ধান যেভাবে
বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতর ১৯৫৭ সালে প্রথম নেত্রকোনার দুর্গাপুরের ভেদিকুড়া নামক স্থানে সাদা মাটির সন্ধান পায়। ১৯৬৪-৬৫ সালের দিকে বিজয়পুর এলাকায় ১৩টি কূপ খনন করে মাটির সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে ১৯৬৮ সালে মাটি তোলার কাজ শুরু করে ১০-১২টি কোম্পানি। এরপর ২০১৫ সালে বেলার মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালে বন্ধ হয় মাটি উত্তোলন।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, সত্যিই দুর্গাপুরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য খুবই সম্ভাবনাময়। এর অপার সৌন্দর্য যে কাউকে মুগ্ধ করে। তাই পর্যটকদের জন্য এরই মধ্যেই তৈরি করা হয়েছে ওয়াশব্লক। সড়কেরও উন্নয়ন করা হয়েছে। মাটির সড়ক দিয়ে মানুষ হেঁটে যেতে পারতো না। এখন সেই সড়কটি গ্রামীণ অবকাঠামো হিসেবে উন্নয়ন করা হয়েছে। দুপাশে গাছ লাগিয়ে এর সৌন্দর্য আরও বাড়ানো হবে। এছাড়াও স্থানটিকে ঢেলে সাজাতে নেয়া হচ্ছে নানা পরিকল্পনা।