বাস-ট্রেনে ভিড় কম, মহাসড়কে স্বস্তি
চিরচেনা ভিড় নেই রেলস্টেশনে। শিডিউলের বিপর্যয় নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে না টার্মিনালে। যাত্রীদের হট্টগোল নেই। মহাসড়কে নেই দীর্ঘ যানজট। ঈদযাত্রা এবার স্বস্তিদায়ক হওয়ার কথা। কিন্তু তীব্র গরমের কারণে সেই স্বস্তি মিলছে না। তীব্র দাবদাহে ঘরমুখো মানুষ ভোগান্তিতে পড়েছে। গরমের কারণে যাত্রাপথেই অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বাস, ট্রেন, লঞ্চে হাতপাখা নিয়ে উঠেছেন কেউ কেউ।
গত বুধবার শুরু হয়েছে ঈদের ছুটি। এরপর নাড়ির টানে বাড়ির পথে শহুরে মানুষ। উদ্দেশ্য- প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করা। প্রতি বছর এই ঈদযাত্রায় মানুষের ভোগান্তির অন্ত থাকে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাস টার্মিনালে দাঁড়িয়ে থেকেও মিলতো না টিকিট। একই অবস্থা ট্রেন ও লঞ্চেও। কালোবাজারিতে অতিষ্ঠ ছিল মানুষ। কিন্তু এবারের চিত্র একেবারেই আলাদা। কোনো ধরনের ঝক্কি ঝামেলা ছাড়া স্বস্তি নিয়ে নাড়ির টানে ছুটছে মানুষ।
রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনে দেখা যায়, কড়া চেকিংয়ে স্টেশনের ভেতরে প্রবেশ করছেন যাত্রীরা। ভেতরেও যাত্রীদের কোনো তাড়াহুড়ো নেই। ট্রেনের অপেক্ষায় বসে আছেন। প্ল্যাটফরমে ট্রেন আসলেই সবাই আনন্দের সঙ্গে উঠছেন। নির্দিষ্ট সময় পর পর একের পর এক ছেড়ে যাচ্ছে ট্রেন। শিডিউল বিপর্যয়ের অভিযোগ নেই। ঈদযাত্রায় এমন অভিজ্ঞতায় স্বস্তি প্রকাশ করছেন যাত্রীরা। তারা জানান, এবারের ঈদযাত্রায় ট্রেনে কোনো ধরনের দুর্ভোগ হয়নি। অনলাইনে টিকিট কাটায় তেমন ভোগান্তি পোহাতে হয়নি। স্বস্তি নিয়েই গ্রামে ফিরতে পারছেন তারা। এবারই প্রথম ‘টিকিট যার, ভ্রমণ তার’ কার্যক্রম শুরু করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। গত ৭ই এপ্রিল থেকে অনলাইনে শুরু হয় নিজের এনআইডির (জাতীয় পরিচয়পত্র) মাধ্যমে যাত্রীদের টিকিট প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় টিকিটের সঙ্গে এনআইডি মিলিয়ে তারপরেই প্ল্যাটফরমে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে যাত্রীদের। তিন স্তরে টিকিট চেকিং করা হচ্ছে। টিকিট ছাড়া কোনো যাত্রীকেই স্টেশনের ভেতরে প্রবেশ করতে দিচ্ছেন না নিরাপত্তা প্রহরীরা। এদিন ট্রেন ধরতে সকাল থেকেই স্টেশনে আসা শুরু করেছিলেন যাত্রীরা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে যাত্রীদের উপস্থিতিও। তবে আগের সেই বিশৃঙ্খলা, ভোগান্তি চোখে পড়েনি যাত্রীদের। অনলাইনে রেলের টিকিট বিক্রিকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন তারা। কমলাপুর থেকে রাজশাহী যাবেন সিফাত। ঈদের আগে ভোগান্তিহীন ট্রেন যাত্রায় কিছুটা বিস্মিত হয়েছেন তিনি। বলেন, ঈদে ট্রেনে বাড়ি যেতে আমাদের নানা সমস্যায় পড়তে হয়। টিকিটের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়াতে হয়। টিকিট কাটার পরও সিটে বসার মতো অবস্থা থাকতো না। কিন্তু এবার এসব সমস্যার কিছুই হয়নি। অনলাইনে ঘরে বসেই টিকিট করা গেছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও গণসংযোগ কর্মকর্তা কামাল হোসেন দুই সন্তানকে নিয়ে চট্টগ্রাম যাচ্ছিলেন। গতকাল দুপুরে ট্রেনের জন্য স্টেশনে বসে অপেক্ষা করছিলেন। তিনি বলেন, এবার টিকিট কেটেও শান্তি পেয়েছি। স্টেশনেও কোনো ভিড় নেই। এখন পর্যন্ত সব ঠিকঠাক আছে। আশাকরি সুন্দরভাবে যেতে পারবো। পাবনার যাত্রী রুবেল বলেন, শুরুতে অনলাইনে টিকিট পাচ্ছিলাম না। কয়েকবার চেষ্টা করার পর টিকিট পেয়ে যাই। এখন স্টেশনে আসার পর আর কোনো সমস্যা হয়নি। কমলাপুর স্টেশন ম্যানেজার মাসুদ সারওয়ার বলেন, টিকিট বিক্রি সম্পূর্ণ অনলাইন করায় এখন পর্যন্ত যাত্রীরা আরামদায়কভাবে ঈদযাত্রা করতে পারছেন। এখনো কোনো ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় হয়নি। সার্বিকভাবে আমাদের প্রস্তুতিও ভালো। প্রতিটি ট্রেনে ২৫ শতাংশ স্ট্যান্ডিং টিকিটের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। গার্মেন্ট ছুটি হলে যাত্রীর চাপ বাড়বে তখন এমন পরিবেশ বজায় রাখা চ্যালেঞ্জিং হবে। তবে রেল কর্তৃপক্ষের চেষ্টা থাকবে। প্রতিদিন ৫৫ জোড়া আন্তঃনগরসহ লোকাল ও মেইল ট্রেনে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ ঢাকা ছাড়ছে।
অন্যদিকে বাস টার্মিনালগুলোতেও যাত্রীর চাপ নেই। রাজধানীর গাবতলী, মহাখালী ও সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে অন্য বছরের মতো মানুষের ভিড় দেখা যায়নি। মহাসড়কে যানজট না থাকায় যথা সময়েই ছেড়ে যাচ্ছে একের পর এক বাস। টিকিটের কালোবাজারির অভিযোগও নেই যাত্রীদের। গাবতলীতে কমেছে ট্রিপের সংখ্যাও। সরজমিন দেখা যায়, দক্ষিণাঞ্চলের বিপুলসংখ্যক যাত্রী পদ্মা সেতু হয়ে পথ ধরায় অন্য বছরের মতো ঘরমুখো মানুষের চাপ নেই গাবতলী বাস টার্মিনালে। কাউন্টারে অলস সময় পার করছেন টিকিট বিক্রেতারা। আবার প্রধান সড়ক ও টার্মিনালের অনেক পরিবহন শ্রমিককে দেখা যায় যাত্রী ডেকে ডেকে বাসে তুলতে। তবে গতকাল সকালের দিকে অগ্রিম টিকিটের যাত্রীদের চাপ কিছুটা ছিল। টিকিট বিক্রেতারা জানান, দক্ষিণাঞ্চলের অধিকাংশ যাত্রী পদ্মা সেতু হয়ে বাড়ি যাচ্ছে। এজন্য গাবতলী টার্মিনালে চাপ অনেক কমেছে। আগে যেখানে দিনে ১০ ট্রিপেরও বেশি হতো, এখন সেটি ৪ ট্রিপে নেমেছে। ঝিনাইদহ যাওয়ার জন্য গাবতলী এসেছেন মো. রশিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, বাসা গাবতলীর পাশে হওয়ায় অগ্রিম টিকিট কাটিনি। একটু আগে এসে টিকিট কাটলাম। ঈদের কোনো চাপ দেখছি না। কালীগঞ্জ এক্সপ্রেসের টিকিট বিক্রেতা মো. মসলেম বলেন, পদ্ম সেতু হয়ে যাওয়ার পরে গাবতলীতে চাপ কমেছে। আগে আমরা প্রতিদিন ১০ ট্রিপ মারতাম। এখন সেটি ৪ থেকে ৫ ট্রিপে নেমেছে। তবে এতে যাত্রীদের ভোগান্তি কমেছে। তাদের যেতে সময় কম লাগছে। দক্ষিণবঙ্গে চলাচলকারী কমফোর্ট লাইন পরিবহনের টিকিট বিক্রেতা মো. সোহেল বলেন, সকালে দুই-আড়াই ঘণ্টা যাত্রীদের চাপ ছিল। তাও অগ্রিম টিকিটের যাত্রীদের। এ বছর গাবতলী থেকে দক্ষিণবঙ্গের যাত্রী ওভাবে যাচ্ছে না। সবাই পদ্মা সেতু হয়ে যাচ্ছে। তাই এখানে চাপ কম। তাছাড়া নবীনগর থেকে গার্মেন্টের যাত্রী বেশি যাচ্ছে। শ্যামলী পরিবহনের টিকিট বিক্রেতা স্বপন চন্দ্র দাস বলেন, গাবতলীর অবস্থা স্বাভাবিক। সকালে অগ্রিম টিকিটের যাত্রীদের চাপ ছিল। দক্ষিণবঙ্গের যাত্রীদের একটু চাপ ছিল, কিন্তু উত্তরবঙ্গের যাত্রীদের তেমন চাপ নেই।
তবে ভিড় রয়েছে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে। গতকাল ভোর থেকেই যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড় দেখা যায়। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর সদরঘাটে যাত্রীর ভাটা পড়ে। যাত্রী সংকটে কমতে শুরু করে লঞ্চের সংখ্যাও। তবে, আসন্ন ঈদকে সামনে রেখে যাত্রীর চাপ বাড়ায় পুরোনো রূপে ফিরেছে লঞ্চ টার্মিনাল। গতকাল নিয়মিতভাবে চলাচলকারী লঞ্চগুলো পূর্ণ যাত্রী নিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছেড়ে গেছে। খালি ছিল না কেবিন। ডেকেও দেখা গেছে যাত্রীদের ভিড়। এ ছাড়া সকালে লঞ্চ না থাকলেও বরিশাল, ভোলা, বরগুনা, হাতিয়া, পটুয়াখালীগামী যাত্রীদের অনেকেই এসেছেন কেবিন বুকিং দিতে এবং আগেভাগেই ডেকে জায়গা নিতে। চাঁদপুরগামী যাত্রী ইসমাইল বলেন, ঈদ উপলক্ষে মঙ্গলবার অফিস থেকে ছুটি পেয়েছি। সবকিছু রেডি করে আজ রওনা দিয়েছি। গরমের তীব্রতা বাড়ার আগেই বাড়ি পৌঁছাতে পারি সেজন্য সেহরি খাওয়ার পর পরই পরিবার নিয়ে টার্মিনালে এসেছি। এদিকে, যাত্রীদের চাপ বাড়ায় লঞ্চ কেবিনগুলোর ভাড়া স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বাড়ানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেন যাত্রীরা। তবে, আগে বুকিং দেয়া কেবিনের ভাড়া স্বাভাবিক ছিল। এ ছাড়া বরিশালগামী লঞ্চগুলোর ভাড়া স্বাভাবিক থাকলেও ভোলাগামী লঞ্চগুলোর ভাড়া স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশি বলে জানান যাত্রীরা। এমভি সুরভী-৭ লঞ্চের স্টাফ নূরে আলম বলেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর থেকে আমাদের যাত্রীর সংখ্যা একেবারেই কমে গেছে। ঈদ উপলক্ষে যাত্রী বেশ বেড়েছে।
এদিকে তাপমাত্রার পারদ সামান্য নিম্নগামী হলেও দাবদাহ কমছে না। গরমে অতিষ্ঠ জনজীবন। ঈদযাত্রায় যা ভোগান্তির সৃষ্টি করেছে। গতকালও রেকর্ড তাপমাত্রা ছিল চুয়াডাঙ্গায় ৪২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঈদের উদ্দেশ্যে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাচ্ছিলেন রাকিব হোসেন নামের এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, এবার কাউন্টারে ভোগান্তি নেই বললেই চলে। তবে গরমে অতিষ্ঠ লাগছে। সুস্থভাবে বাড়ি ফেরাই চ্যালেঞ্জ। আবহাওয়া অধিদপ্তর গতকাল সকাল ৯টায় পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার আবহাওয়া পূর্বাভাস দিয়েছে। যেখানে বলা হয়, দেশের চার জেলায় প্রচ- তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া চার বিভাগের বিভিন্ন জেলায় বইছে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ। এ পরিস্থিতি আজ পর্যন্ত চলতে থাকবে। আবার তিন বিভাগের দু-এক জায়গায় বৃষ্টির সম্ভাবনার কথাও বলা হয়েছে। এপ্রিলের শুরু থেকেই গরম পড়তে শুরু করেছে। প্রথমে মৃদু থেকে মাঝারি, পরে বিভিন্ন এলাকায় প্রচ- তাপপ্রবাহ শুরু হয়। বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকায় ঘাম কম হলেও শুষ্ক আবহাওয়া বিরাজ করতে থাকে। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, দিনাজপুর, রাজশাহী, পাবনা ও চুয়াডাঙ্গা জেলার ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। পঞ্চগড়, রংপুর, নীলফামারী, মৌলভীবাজার, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলা এবং রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের অবশিষ্টাংশসহ ঢাকা ও বরিশাল বিভাগের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে।