দেশের প্রতিথযশা শিল্পপ্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপের চেয়ারম্যান ও এমডি আলহাজ্ব মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন এর আজ মঙ্গলবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। গেল বছরের এদিনে ব্যাংককের একটি হাসপাতালে (২৮ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশ সময় বিকেল ৩:১৫ মিনিটে তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন।
খ্যাতিমান শিল্পপতি নাছির উদ্দিন সরাসরি রাজনীতিতে সম্পৃক্ত না থাকলেও সীতাকুণ্ডের রাজনীতি ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে রয়েছে তাঁর প্রবাদতুল্য অবদান। পঁচাত্তোর রাজনীতির দুঃসময়ে পরাজয় নিশ্চিত জেনেও রাজনীতির স্বার্থে বড়ভাই সাবেক এমপি ও প্যানেল স্পীকার এ বি এম আবুল কাসেম মাস্টারকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সীতাকুণ্ড থেকে ৫বার এমপি পদে নির্বাচন করিয়েছেন। বড়ভাইয়ের প্রতি আন্তরিকতা, মমত্ববোধ, উদারতা ও ত্যাগের সুমহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। সীতাকুণ্ডের আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে তিনি জীবদ্দশায় অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছেন। ব্যবসায়িক ক্ষেত্রেও তিনি সফলতার স্বর্ণশিখরে অবস্থান করেছেন।
বিশিষ্ট শিল্পপতি, শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবক আলহাজ্ব মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন নিজপ্রচেষ্টায়, পরিশ্রম,সাধনা ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে যিনি দেশের পোশাকশিল্পের নামজাদা শিল্পপতি হিসেবে দেশ-বিদেশে যথেষ্ট যশ-খ্যাতি অর্জন করেছেন, নিজের হাতেগড়া শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে তিলতিল করে এমন এক অনন্যমাত্রায় নিয়ে এসেছেন- একসময় দেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা পর্যন্ত তাঁর পোশাককারখানা পরিদর্শন করেছেন।
নাছির উদ্দিন ১৯৫০ সালের ১৫ ডিসেম্বর সীতাকুণ্ড উপজেলার ছলিমপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ ছলিমপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর পিতা আবদুল জলিল এবং মাতা আমেনা খাতুন। ৪ ভাই ও ৩ বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত সাহসী এবং অনুসন্ধিৎসু ছিলেন তিনি। ছাত্রজীবনে লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধূলায় ছিলেন অত্যন্ত পারদর্শী। ১৯৬৫ সালে কাট্টলী নুরুল হক উচ্চবিবদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, ১৯৬৭ সালে চট্টগ্রাম সিটি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক এবং ১৯৭০ সালে সিটি কলেজ থেকে ব্যবসায়িক প্রশাসনে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ১৯৬৮ সালে লেখাপড়ার পাশাপাশি পারিবারিক ব্যবসার সাথে যুক্ত হন।
তৎকালীন র্পূব পাকিস্তানে খাতুনগঞ্জভিত্তিক আমদানি বাণিজ্যের মাধ্যমে ব্যবসায়ী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ১৯৭২ সালে ডিপ-সি ট্রলিং এর মাধ্যমে বাংলাদেশের মৎস্য শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত হন। পরবর্তীতে ১৯৮০ সালে ভাটিয়ারিতে স্থাপন করেন ‘এন জেড এন শিপ ব্রেকিং লিমিটেড’ এবং একই সালে নাসিরাবাদে স্থাপন করেন ‘ফরিদপুর স্টীল রি-রোলিং মিল’।
উল্লেখ্য, নাছির উদ্দিন বাংলাদেশের শিপ ব্রেকিং ইন্ডাস্ট্রি এর প্রাথমিক উদ্যোক্তাদের একজন।
নাছির উদ্দিন ১৯৮৩ সালে পদার্পণ করেন পোশাকশিল্পে। যাত্রা শুরু হয় এনজেডএন গার্মেন্টস লিমিটেড দিয়ে। বাংলাদেশের পোশাকশিল্প তখন ঊষালগ্নে। চরম প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে তিনি পোশাকশিল্প শুরু করেন ৫শ’ লোকবল দিয়ে। দেশে দক্ষ জনশক্তির অভাব পরিলক্ষিত হওয়ায় বিদেশ থেকে নিয়ে আসেন সুদক্ষ কর্মীবাহিনী। আশির দশকে বাংলাদেশ বহির্বিশ্বের কাছে পরিচিত ছিল দুর্ভিক্ষ এবং বন্যাকবলিত গরীব দেশ হিসেবে। সেসময় অদম্য সাহস নিয়ে নাছির উদ্দিন উন্নত দেশগুলোতে ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপনের প্রচেষ্টায় নিয়োজিত হন। বাংলাদেশকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেন পোশাকশিল্পের এক সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে। একে একে বাংলাদেশে পাড়ি জমাতে থাকে উন্নতবিশ্বের সকল পোশাক ক্রেতারা। তাঁর এ উদ্যোমে উৎসাহিত হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় আরো অনেক পোশাক শিল্পপ্রতিষ্ঠান।
এ সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ১৯৯৪ সালে চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলে (CEPZ) প্রতিষ্ঠা করেন ‘প্যাসিফিক জিন্স লিমিটেড’। পোশাকশিল্পের গতানুগতিক ধ্যান ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে আধুনিক এবং উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদন প্রক্রিয়ার প্রবর্তন করেন বাংলাদেশে। শুধু তাই নয়, পণ্যের গুণগত মান উন্নয়নে এবং পোশাকশিল্পকে একটি গবেষণানির্ভর শিল্পে পরিণত করার প্রয়াসে আত্মনিয়োগ করেন। এর ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো পোশাক ক্রয় শুরু করে বিশ্ববিখ্যাত প্রথম সারির ফ্যাশন ব্র্যান্ডসমূহ।ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ব্যবসার পরিসর। ২০০১ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন জিন্স ২০০০ লিমিটেড এবং ২০০৮ সালে শুরু করেন ইউনিভার্সেল জিন্স লিমিটেড নামের রপ্তানিমুখী পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপে কর্মরত আছে প্রায় ৩৫ হাজার কর্মকর্তা ও কর্মচারী। বিশ্বের প্রায় ২৫টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে প্যাসিফিক জিন্সের পণ্য।
বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের সর্বোচ্চ রপ্তানিকারক হিসেবে প্যাসিফিক জিন্স বিগত কয়েকবছর ধরে টানা জাতীয় রপ্তানী ট্রফি অর্জন করে আসছে। নাছির উদ্দীন বাংলাদেশের পোশাকশিল্প বিকাশে অসাধারণ অবদানের জন্যে ২০০৬ সালে Businessman of the year পুরস্কারে ভূষিত হন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশের একজন প্রথম সারির শিল্পপতির স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক Commercial Important person (CIP) হিসেবে সম্মানিত ছিলেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।
প্রতিবছর সরকারি কোষাগারে আয়কর প্রদানে প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপ অনন্য নজির স্থাপন করে আছে।
বাংলাদেশ পোশাকশিল্প সংগঠন বিজিএমইএ এর তিনি একজন প্রতিষ্ঠাতা , বিজিএমইএ এর জন্মলগ্ন থেকে সাংগঠিতভাবে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সাথে তিনি নিবিড়ভাবে জড়িত ছিলেন।
ব্যবসায়িক সাফল্যের পাশাপাশি সমাজসেবায় তিনি স্থাপন করেছেন অনন্য দৃষ্টান্ত। সীতাকুণ্ড উপজেলায় শিক্ষার আলো বিকাশে প্রতিষ্ঠা করেছেন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল। এর মধ্যে উল্লেখ্যযাগ্য হলো তাঁর বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত ‘লতিফপুর আলহাজ্ব আবদুল জলিল উচ্চবিদ্যালয়’ এবং মাতার নামে প্রতিষ্ঠিত ‘আমেনা বিদ্যানিকেতন’। এছাড়া তিনি সীতাকুণ্ডে নারী শিক্ষাকে বেগবান করার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন ‘হযরত কালুশাহ্ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়’ ও বাড়বকুণ্ড স্কুল এন্ড কলেজ এর নতুন একাডেমিক ভবন। এর পাশাপাশি বিভিন্ন মসজিদ, মন্দির , মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ, এবং অন্যান্য সামাজিক কর্মকাণ্ডের সাথে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। তাঁর এই সামাজিক দায়বদ্ধতাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘প্যাসিফিক জিন্স ফাউন্ডেশন’- যা সীতাকুণ্ডবাসীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
আলহাজ্ব মোহাম্মদ নাছির এর মৃত্যুর পর প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপের এমডির স্থলাভিষিক্ত হন তারই জেষ্ঠ্য সন্তান সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর। তিনি বাবার নীতি আদর্শ, কর্মস্পৃহা রপ্ত করে প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপের হাল ধরেছেন খুব শক্তভাবে। আরও দুই ছেলে সৈয়দ মোহাম্মদ তানসীর, সৈয়দ মোহাম্মদ তাহমীর পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন।