এ মাসের শুরুতে তুরস্কে যখন ভূমিকম্প আঘাত হানে তখন এপিসেন্টার থেকে ৩২২ কিলোমিটার দূরে ছিলেন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক মির আলী কোকার। তিনি দ্রুত তার মাইক্রোফোন ও ক্যামেরা নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে পৌঁছান। এরপরের দিনগুলোতে আলী একের পর এক খবর পোস্ট করতে থাকেন উদ্ধারকার্য নিয়ে। যারা বেঁচে গেছেন তাদের গল্পগুলো তিনি টুইটারে তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু এটিই কাল হয় তার জন্য। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে ‘ভুয়া খবর’ ছড়ানোর অভিযোগ এনেছে তুরস্ক কর্তৃপক্ষ। এরফলে তার তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।
শুধু আলী একাই নয়, এমন অন্তত চার তুর্কি সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ভূমিকম্প নিয়ে ভুয়া খবর প্রচারের অভিযোগ আনা হয়েছে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে সক্রিয় সংস্থাগুলো বলছে, এমন অভিযোগে কয়েক ডজন সাংবাদিককে আটক, হেনস্থা এবং রিপোর্টিং-এ বাধা দেয়া হয়েছে। এই রিপোর্ট লেখার সময় ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা দুই দেশে ৫০ হাজার ছাড়িয়েছে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে রিপোর্ট করতে গিয়ে সাংবাদিকদের এখন সাবধান হতে হচ্ছে।
আলী নিজে জাতিগতভাবে একজন কুর্দি।
তিনি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েফ এরদোগানের সমালোচক হিসেবে পরিচিত দু’টি গণমাধ্যমে রিপোর্ট প্রকাশ করেন। তার প্রকাশিত রিপোর্টগুলোতে ভূমিকম্পের পর সরকারের নানা অনিয়ম ও ব্যর্থতার চিত্র ফুটে ওঠে। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন যে, অনেক দিন পার হয়ে যাওয়ার পরেও তারা কোনো ত্রাণ বা সাহায্য পাননি। এসব দাবিই প্রচার করছিলেন আলী। এর ফলেই তিনি সরকারের টার্গেটে পরিণত হয়েছেন।
ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলো পরিদর্শনে গিয়ে এরদোগান শহরগুলোকে নতুন করে তৈরির প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু একই সঙ্গে যারা ভুয়া খবর ছড়াচ্ছে এবং ‘সমাজে অস্থিতিশীলতা’ সৃষ্টি করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি দেন। আলী জানিয়েছেন, পুলিশ তার অ্যাপার্টমেন্টে একটি নোট রেখে গেছে যাতে তাকে বলা হয়েছে পুলিশ স্টেশনে হাজিরা দিতে। স্টেশনে গেলে পুলিশ তাকে জানায় যে, তার বিরুদ্ধে ‘ভুয়া তথ্য প্রচার আইনের’ অধীনে তদন্ত চলছে। তাকে তার রিপোর্টগুলো নিয়ে নানা প্রশ্ন করে পুলিশ।
গত বছরের অক্টোবর মাসে নতুন এই আইন প্রণয়ন করে তুরস্ক। এই আইন রাষ্ট্রকে গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণে আরও ক্ষমতা প্রদান করে। তবে মানবাধিকার ও সাংবাদিকদের সংস্থাগুলো এই আইনকে দমনমূলক বলে অভিযোগ জানিয়ে আসছে। দেশটির বিরোধী দলগুলোও এই আইনের তীব্র সমালোচনা করছে।
আলীর দাবি, তিনি তার খবর সংগ্রহের ক্ষেত্রে কোনো পক্ষপাতিত্ব করেননি। তিনি আক্রান্ত থেকে শুরু করে পুলিশ সকলের বক্তব্যই প্রচার করেছেন। তথ্যের নিশ্চয়তা পাওয়া না পর্যন্ত তিনি কোনো খবর প্রচার করতেন না বলেও দাবি করেন আলী। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স এক বিবৃতিতে আলীর বিরুদ্ধে তুরস্ক সরকারের এই অভিযোগকে বানোয়াট বলে বর্ণনা করেছে। তারা দাবি করেছে, অবিলম্বে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এই তদন্ত বন্ধ করতে হবে। কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস বা সিপিজে জানিয়েছে, আলীর মতো আরও অন্তত তিন সাংবাদিককে এমনভাবে আইনের মুখোমুখি করা হচ্ছে।
তাদের মধ্যে আছেন, মেরদান ইয়ানারদা ও এনভার আইসেভার। তারা ইস্তাম্বুলভিত্তিক বিশিষ্ট রাজনৈতিক আলোচক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের বিপুলসংখ্যক অনুসারী আছেন। তারা দুজনেই ভূমিকম্পে সরকারের উদ্ধার তৎপরতা নিয়ে সমালোচনা করেছেন। আর মেহমেত গুল নামের একজন মির আলীর মতোই দিয়ারবাকিরে থাকেন। এই তিনজনের বিষয়েই তদন্ত চলছে। সরকারের উদ্ধার প্রচেষ্টার সমালোচনাকারী একজন স্বেচ্ছাসেবকের সাক্ষাৎকার নেওয়ায় তাকে ‘বিদ্বেষ উসকে দেয়ার’ সন্দেহে মেহমেত গুলকে আটক করে পরে ছেড়ে দেয়া হয়।
ঠিক কতজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে, তা এখনো জানা যায়নি। গত মঙ্গলবার পুলিশ বলেছে, তারা ‘উসকানিমূলক পোস্ট’ দেওয়ার জন্য ১৩৪ জনকে আটক করেছে। তাদের মধ্যে পরে ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে আটক ও গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। তবে সমালোচকেরা বলছেন, বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোর চেয়েও যেকোনো সমালোচনা শক্ত হাতে দমন করার বিষয়টি অনেক দূর এগিয়ে গেছে। ইস্তাম্বুলের বিলগি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাইবার অধিকার বিশেষজ্ঞ ইয়ামান আকদেনিজ বলেন, সরকার ভূমিকম্প অঞ্চল থেকে আসা তথ্য গোপন করার চেষ্টা করছে।