জার্মানির অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান ২০২২ সালের অক্টোবরে একটি রূপকের উত্থাপন করেছিলেন। তিনি রাশিয়াকে তুলনা করেছিলেন ঝড়ের সঙ্গে, আর চীনকে তুলনা করেছিলেন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতীক হিসেবে। (“Russia is the storm; China is climate change.” ). তাঁর সেই উক্তি আজ ঘোর বাস্তবে পরিণত হতে চলেছে, বিশ্ববাসী আজ একটি অশান্ত ভূ-রাজনৈতিক পরিবেশ প্রত্যক্ষ করছে। বর্তমান বৈশ্বিক সংকট ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে হতে পারে- যা প্রায় এক বছর ধরে আন্তর্জাতিক মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছে। তবে ২১ শতকের মূল চালিকা শক্তি হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে চলমান প্রতিযোগিতা। এর মধ্যে একটি চীনা বেলুনের মার্কিন আকাশসীমায় অনুপ্রবেশ বিতর্ক আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। ওয়াশিংটন বিষয়টিকে চীনা গুপ্তচরবৃত্তির একটি বৃহত্তর কর্মসূচির অংশ বলে দাবি করেছে। গত নভেম্বরে বালি জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে বৈরিতা বন্ধ করার সংকেত সত্ত্বেও, দুটি শক্তি স্পষ্টতই বিশ্বব্যাপী আধিপত্যের লড়াইয়ে লিপ্ত। এই নতুন শীতল যুদ্ধের ডানা নীল গ্রহের বিভিন্ন প্রান্তে ক্রমেই প্রসারিত হচ্ছে।
বেশ কিছু সাম্প্রতিক ঘটনা দেখায় যে, দুটি পরাশক্তি অভ্যন্তরীণভাবে যা কিছুই করুক না কেন-যেমন তাদের সামরিক, প্রযুক্তিগত বা অর্থনৈতিক পেশীকে শক্তিশালী করতে চাওয়া- উভয়ই বিভিন্ন উপায়ে তাদের আন্তর্জাতিক অবস্থানকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আগ্রহী।
বেশ কিছুদিন ধরেই এই উত্তেজনা বাড়ছে। ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের এক এক্সক্লুসিভ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর চায়না মোবাইল এবং চায়না টেলিকম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া-মধ্য পূর্ব-পশ্চিম ইউরোপ ৬ সাবমেরিন কেবল প্রকল্প থেকে নাম প্রত্যাহার করে নেয়, যখন আমেরিকান ফার্ম সাবকমকে চীনের প্রধান ফাইবার-অপটিক কেবল প্রস্তুতকারক হেংটং মেরিন-এর জন্য নির্বাচিত করা হয়েছিল।
এই বছরের শুরুতে, ফিলিপাইন পেন্টাগনকে তার আরও চারটি সামরিক ঘাঁটিতে প্রবেশাধিকার দিয়েছে। ইতিমধ্যে, জাপান এবং নেদারল্যান্ডস চীনে মাইক্রোচিপ রপ্তানির উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা মেনে নিয়েছে ,অন্যদিকে টোকিও এবং ওয়াশিংটন তাদের প্রতিরক্ষা জোট প্রসারিত করেছে। ২০২২ সালের গ্রীষ্মে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে চারটি এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশ অংশগ্রহণ করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনকে কৌশলে ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল, বিশেষত চীনা কার্যকলাপকে অপদস্থ করার উদ্দেশ্যে। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে তাইওয়ান আমেরিকান সরকারের কাছ থেকে সামরিক খাতে অর্থ সাহায্য পাবে। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাজ্য হাইপারসনিক অস্ত্র অন্তর্ভুক্ত করার জন্য পারমাণবিক সাবমেরিনগুলিতে তাদের সহযোগিতা সম্প্রসারণ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলো।
এদিকে, চীন ইউক্রেন আক্রমণের ঠিক আগে রাশিয়ার সাথে একটি “নিঃশর্ত” সম্পর্ক নিশ্চিত করেছে। তারপরে, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে, প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তেল-সমৃদ্ধ রাজ্যের সাথে সম্পর্ক জোরদার করার অভিপ্রায়ে সৌদি আরবের রিয়াদে একটি গুরুত্বপূর্ণ সফর করেছিলেন। যখন ওয়াশিংটনের সাথে সৌদির সম্পর্ক অবনতির দিকে।মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে দেখা করার জন্য সফরের এক মাস আগে, চীনা রাষ্ট্রপতি বেইজিংয়ে জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ স্কোলজকে স্বাগত জানান।
এই বৈঠকটিকে অনেকেই দেখছেন ইউরোপকে সম্পূর্ণরূপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে হাত মেলাতে বাধা দিতে চীনের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে। চীন সরকারের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ- (যাকে নিউ সিল্ক রোড নামেও উল্লেখ করা হয়) যা পশ্চিম চীন থেকে পশ্চিম রাশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত একটি অবকাঠামো প্রকল্প, সাম্প্রতিককালে আলোচনার গুরুত্ব হারিয়েছে। ফরাসি বিনিয়োগ ব্যাংক নাটিক্সিসের এশিয়ার প্রধান অর্থনীতিবিদ অ্যালিসিয়া গার্সিয়া হেরেরো বলছেন -”আমরা এক ধরনের শীতল যুদ্ধের মধ্যে আছি। আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে একটি দুর্দান্ত কৌশলগত প্রতিযোগিতা প্রত্যক্ষ করছি, যারা কেবল তাদের নিজস্ব বোর্ডে নয়, বিশ্বব্যাপীও খেলছে। অনেকেই ভেবেছিলেন বালিতে শি -এর সাথে বাইডেনের সাক্ষাতের পর হয়তো তাপমাত্রার পারদ নামবে, আমি মনে করি এর কোনো পরিবর্তন হবে না। শুধুমাত্র এই কারণেই নয় যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনে রপ্তানির উপর বিধিনিষেধ আরোপ করছে, বরং উভয় দেশের একটি এজেন্ডা রয়েছে যা কঠিন প্রতিযোগিতার দিকে নির্দেশ করে।”
বোস্টন ইউনিভার্সিটির পারডি স্কুল অফ গ্লোবাল স্টাডিজের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক জর্জ হেইন ( চীনে চিলির রাষ্ট্রদূত হিসাবেও কাজ করেছেন ) বলেছেন যে ”আমরা একটি দ্বিতীয় ঠান্ডা যুদ্ধের মুখোমুখি হচ্ছি। ২০২০ সাল থেকে এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সেইসময়ে এটি কোনো সামরিক প্রভাব ছাড়াই একটি বাণিজ্যিক-প্রযুক্তিগত দ্বন্দ্ব ছিল। কিন্তু এখন সংঘাতের পরবর্তী উপাদানগুলি এই দ্বন্দে সম্পৃক্ত হতে চলেছে , যা ক্রমেই আরো স্পষ্ট হয়ে উঠছে।অবশ্যই, চীনের অর্থনীতির আকার এবং দুই দেশের পারস্পরিক নির্ভরতার কারণে এই দ্বিতীয় শীতল যুদ্ধর সঙ্গে প্রথমটির পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু, আরও অনেক উপাদান রয়েছে যেদিক থেকে বিচার করলে এই ঠান্ডা যুদ্ধ খানিকটা একই রকম। এবং অবিলম্বে এটি পরিবর্তিত হবে এমন কোনও লক্ষণ নেই। ”
বার্লিন-ভিত্তিক মার্কেটর ইনস্টিটিউট ফর চায়না স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক মিকো হুওতারির মতে, ” পার্থক্য থাকলেও প্রথম স্নায়ুযুদ্ধের সাথে দৃঢ় মিল স্পষ্ট। পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার উপাদান থেকে আদর্শগত দ্বন্দ্ব এখানেও উপস্থিত। আমরা ধীরে ধীরে সংঘাতের একটি প্রবাহে প্রবেশ করেছি।”
বিশ্বের মানচিত্রে দুই শক্তির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কীভাবে চলছে তা দেখুন:
ইন্দো-প্যাসিফিক
এই অঞ্চলটি উভয় দেশের কাছে তীব্র আকর্ষণের বিষয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের সাথে সম্পর্ক জোরদার করছে। যেমন Aukus জোট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র অস্ট্রেলিয়াকে পারমাণবিক চালিত সাবমেরিনের একটি বহর রাখার অনুমতি দিয়েছে। তাইওয়ানের জন্য আমেরিকার ক্রমবর্ধমান সমর্থন রয়েছে, মহাকাশের ডোমেইন মোকাবেলায় মার্কিন-জাপানি জোটের সম্প্রসারণ বেড়েছে , সেইসাথে ফিলিপাইনে সামরিক ঘাঁটিতে আমেরিকান প্রবেশাধিকার বৃদ্ধি পেয়েছে। হুওতারি বলেছেন, ”মার্কিন হাইকমান্ড ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে, কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় সামরিক পরিবর্তন দেখা যাবে। ”কিন্তু ওয়াশিংটন ভিন্ন মাত্রায় কাজ করছে। বিশেষজ্ঞরা ভারতকে কাছাকাছি আনার কৌশলগত প্রয়াসকে উল্লেখ করেছেন। হেইন তার নোটে বলেছেন, ”এই শতাব্দীর প্রথম দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মনোনিবেশ করেছিল। ওবামা ইতিমধ্যেই এটি পরিবর্তন করার চেষ্টা করেছেন, যাকে তিনি এশিয়ার প্রতি ‘বিশেষ নজর’ বলে অভিহিত করেছেন। যেখানে মধ্যপ্রাচ্য ওয়াশিংটনের মনোযোগ পেতে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আসলে একটু একটু করে পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। এই ভিশনে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।”
যুক্তিটি সুস্পষ্ট, ভারতের আকার এবং চীনের সাথে সমস্যাগুলি এর প্রধান কারণ। ওয়াশিংটন বছরের পর বছর ধরে এই সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছে, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে স্পষ্ট সম্পর্ক ছিলো। চতুর্মুখী নিরাপত্তা সংলাপ ফোরাম ( Quadrilateral Security Dialogue forum ) থেকে এবং অতি সম্প্রতি, বাইডেন প্রশাসন ভারতকে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ দেশ হিসাবে চিহ্নিত করার পর মার্কিন কোম্পানিগুলি চীনের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে ভারতের ওপর মনোনিবেশ করছে। উদাহরণস্বরূপ, অ্যাপল এই বিষয়ে কাজ করছে: ভারত এবং ভিয়েতনামে এর উৎপাদন বেড়েছে। যাইহোক, হাইনের মতে, এই পরিবর্তনের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। “প্রথমত ভারতীয় অর্থনীতি চীনা অর্থনীতির তুলনায় অনেক ছোট; দ্বিতীয়ত নয়াদিল্লি আঞ্চলিক সহযোগিতা প্রক্রিয়ায় একীভূত হয়নি। এছাড়াও চীন অবকাঠামো বিনিয়োগ এবং বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যা অফার করে ভারতের সেই উচ্চতায় পৌঁছাতে দেরি আছে। মার্কিন বাজার বন্ধ। চীন থেকে ডিকপলিং দীর্ঘমেয়াদে গতি পেতে পারে তবে স্বল্প মেয়াদে নয়। কর্মীবাহিনী, রসদ প্রস্তুত করা খুবই কঠিন। ”
এই ফাঁকে চীন তার অংশীদার দেশগুলির সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলছে, যেমন পাকিস্তান। বেইজিং নিউ সিল্ক রোডের অংশ হিসেবে বিনিয়োগের মাধ্যমে সম্পর্ককে শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে। এরকম একটি প্রকল্প হলো লাওসে নির্মিত একটি রেললাইন। ইন্দোনেশিয়ার মতো – স্পষ্টভাবে সংযুক্ত নয় এমন দেশগুলির কাছাকাছি যাওয়ার সংগ্রাম তীব্র হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রায়ই জাকার্তায় যান। দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলির ওপর সিঙ্গাপুরের ইউসুফ ইশাক ইনস্টিটিউট দ্বারা পরিচালিত একটি সমীক্ষা অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আস্থা এবং চীনের প্রতি সন্দেহ বাড়ছে। যদি ‘আসিয়ান” বেছে নিতে হয় তাহলে ৬১% নাগরিক বেছে নেবেন ওয়াশিংটন এবং বেইজিংকে বাছবেন ৩৯%। ২০২২ সালে, অনুপাত ছিল ৫৭ % থেকে ৪৩%। কম্বোডিয়া এবং লাওসও বেইজিং থেকে স্থানান্তর হবার চেষ্টা করছে ।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন/ন্যাটো
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের পরে তৃতীয় বৃহত্তম বৈশ্বিক অর্থনৈতিক খেলোয়াড়। ইইউ এবং ন্যাটো উভয় ক্ষেত্রেই ওয়াশিংটন তার ইউরোপীয় অংশীদারদের বেইজিংয়ের প্রতি তার নীতি সমর্থন করার জন্য জোর দিচ্ছে। ইউরোপে এমন অনেক কণ্ঠস্বর রয়েছে যারা চীনের সাথে সুসম্পর্কের পক্ষে। কেউ কেউ – যেমন ইইউ এবং ন্যাটোর পূর্ব প্রান্তে থাকা রাশিয়ার হুমকির বিরুদ্ধে একমাত্র গ্যারান্টার হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে বিবেচনা করে। এই কারণে, তারা বেইজিংয়ের প্রতি ওয়াশিংটনের প্রস্তাবিত কঠোর নীতি অনুসরণ করতে ইচ্ছুক। কিন্তু অন্যরা বিশেষ করে জার্মানি বিষয়টি নিয়ে সতর্ক। কারণ এই নীতি তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থের উপর খুব গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে। জার্মান সরকার স্পষ্টতই একদিকে জি -৭ ব্লক এবং অন্যদিকে চীন এবং রাশিয়ার আঁতাতকে এড়ানো উপযুক্ত বলে মনে করে। বেইজিং এই ট্রাম্প কার্ডের সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করছে।কৌশলগত কাঁচামাল, সেইসাথে সৌর প্যানেলের মতো সবুজ পরিবর্তনে প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন চীনের উপর নির্ভর করে। এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে, ইউরোপীয় কমিশন তার নিজস্ব পথ তৈরি করতে চায়। তারা কাঁচামালের ক্ষেত্রে বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের গ্যারান্টি দেয়ার পরিকল্পনায় কাজ করছে। উপরন্তু, ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃত্ব চীনের সাথে একত্রিত হওয়ার আমেরিকান নীতি পরিহার করে ভারসাম্যপূর্ণ পদ্ধতির প্রস্তাব করে।
গত গ্রীষ্মে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোকে প্রথমবারের মতো তার কৌশলগত পদক্ষেপে চীনকে অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। তবে ইউরোপীয় মিত্রদের প্রতিরোধের কারণে, রেফারেন্সটি ওয়াশিংটনের প্রত্যাশার চেয়ে কম জোরদার ছিল। হুওতারির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ”আটলান্টিক সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সংহতি বজায় রাখার চেষ্টা রয়েছে শুধুমাত্র আলংকারিক ক্ষেত্রে নয় , প্রাতিষ্ঠানিক কর্মেও। সেদিকে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তবে তা যথেষ্ট হবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ নীতি যে পরিবেশ তৈরি করবে তাকে নেভিগেট করা সহজ হবে না। ” বিশ্লেষক গার্সিয়া হেরেরো মতে, ”দুর্ভাগ্যবশত ইউরোপ এই কৌশলগত প্রতিযোগিতার পুতুল মাত্র। ইউরোপ অনেক বেশি দুর্বল এবং তাই, দুটি শক্তির মধ্যে ইউরোপের অবস্থান কোথায় তা পুরোপুরি সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তাদের কাছে বাস্তবিক বিকল্প নেই।’ ‘ গার্সিয়া মনে করেন ইউরোপ নিজেদেরকে রক্ষা করার ব্যাপারে এতটাই উদ্বিগ্ন ছিলো যে, তারা একক বাজারের ভারসাম্য রক্ষা, প্রতিযোগিতা, সদস্য দেশগুলির মধ্যে ভারসাম্য ইত্যাদি বিষয়গুলো প্রায় ভুলতে বসেছে।
বাকি বিশ্বের অবস্থান
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু সুস্পষ্ট সুবিধা রয়েছে, যা চীনের নেই। আমেরিকার কয়েক দশক ধরে গড়ে তোলা জোটের নেটওয়ার্কের মধ্যে আজ রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত দেশগুলো। এর মধ্যে রয়েছে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো ন্যাটো এবং এশিয়া-প্যাসিফিক অংশীদার ত্রিশটি দেশ। অন্যদিকে বেইজিং দুটি প্রধান পদক্ষেপের সাথে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে: প্রথমত, রাশিয়ার সাথে একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যে নৃশংস যুদ্ধ শুরু হয়েছে তাতে রাশিয়াকে সমর্থন করেছে বেইজিং। পরিবর্তে বিপুল পরিমাণ রাশিয়ান তেল এবং গ্যাস কিনেছে। দ্বিতীয়ত: আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের কয়েক ডজন দেশ সহ বিশ্বের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বেইজিংয়ের কিছু সুবিধা থাকতে পারে। এগুলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা অবহেলিত এলাকা – ওয়াশিংটনের অতীত কর্মের কারণে অনেকেই শীর্ষস্থানীয় বিশ্বশক্তির প্রতি সন্দেহ পোষণ করে। এই দেশগুলির অনেকগুলি গণতন্ত্র, আইনের শাসন বা লিঙ্গ সমতার পাঠ গ্রহণে আগ্রহী নয়। পরিবর্তে, এই সরকারগুলি অবকাঠামো এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অর্থায়ন পছন্দ করে। হাইনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী – ”চীন দীর্ঘদিন ধরে বুঝতে পেরেছে যে বিশ্বের এমন অনেক অঞ্চল রয়েছে যেখানে উন্নয়নের জন্য অর্থায়নের প্রচুর প্রয়োজন রয়েছে। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলি সেই প্রয়োজনকে পর্যাপ্তভাবে কভার করেনি। রাস্তা, বন্দর এবং রেলপথ নির্মাণের দিকে আগ্রহ দেখায়নি। এই অর্থনৈতিক পথের মাধ্যমে রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলছে চাইছে চীন। ”চীন তার ভূমি পুনরুদ্ধারের জন্য আরও কূটনৈতিক কৌশলের দিকে মনোনিবেশ করেছে। ডিসেম্বরে শি জিনপিং-এর রিয়াদ সফর ছিল ওয়াশিংটনের প্রতি একটি শক্তিশালী বার্তা , যার পুরনো আরব মিত্রের সাথে সম্পর্ক অত্যন্ত কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর এমন কোনো কোণ খুঁজে পাওয়া কঠিন যেখানে দুই মহাশক্তির ঠান্ডা যুদ্ধের খবর পৌঁছচ্ছে না। বিশেষ করে একটি জায়গা রয়েছে যা এই নতুন শীতল যুদ্ধকে উত্তপ্ত যুদ্ধে পরিণত করার সম্ভাবনা রাখে। সেটি হলো তাইওয়ান। সেখানে কী হয় তা কেবল সময়ই বলবে।